মাঝরাতে পিঠের ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়? কারণ ও সমাধানে যা করবেন
মাঝরাতে পিঠের ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়? কারণ ও সমাধানে যা করবেন
ঘুম মানুষের জীবনের অপরিহার্য একটি অংশ। কিন্তু যদি প্রতিদিন মাঝরাতে পিঠের ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়, তাহলে তা শুধু শরীরের জন্যই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অনেকেই অভিযোগ করেন যে রাতে ঘুম ভেঙে যায় পিঠে ব্যথার কারণে, কিন্তু সকালে সেই ব্যথা আবার কমে যায় বা থাকে না। এটা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে একাধিক কারণ, যেগুলো সময়মতো শনাক্ত না করলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই আর্টিকেলে আমরা জানবো—
-
মাঝরাতে পিঠের ব্যথা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ,
-
ব্যথার ধরণ,
-
কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন,
-
ও ঘরোয়া কিছু করণীয় যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে।
পিঠের ব্যথা কিভাবে হয়?
পিঠের ব্যথা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
-
অ্যাকিউট (Acute) — হঠাৎ শুরু হয়, কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
-
ক্রনিক (Chronic) — ৩ মাস বা তার বেশি সময় ধরে চলতে থাকে।
কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো ব্যথা সাধারণত একটানা চাপ, পেশীর টান বা মেরুদণ্ডে কিছু সমস্যা থাকার কারণে হতে পারে।
মাঝরাতে পিঠে ব্যথার সম্ভাব্য কারণ
১. ঘুমানোর অস্বস্তিকর ভঙ্গি
ঘুমানোর সময় ভুল ভঙ্গিতে লম্বা সময় থাকার ফলে পিঠের পেশী বা স্নায়ুতে চাপ পড়ে। বিশেষ করে যদি আপনি পেটের উপর ঘুমান, তাহলে ঘাড় এবং পিঠে অতিরিক্ত টান পড়ে যা ব্যথার কারণ হতে পারে।
২. অসুবিধাজনক ম্যাট্রেস বা বালিশ
অনেক সময় আপনার বিছানার ম্যাট্রেসটা হয়তো অনেক পুরনো বা বেশি নরম/কঠিন। ঠিক তেমনি বালিশের উচ্চতা বা গঠন ঠিক না হলে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক রেখা বিঘ্নিত হয়। এই অবস্থায় দীর্ঘ সময় ঘুমালে পিঠের পেশী বা হাড়ে চাপ পড়ে।
৩. ডিস্ক জনিত সমস্যা (Slipped Disc বা Herniated Disc)
মেরুদণ্ডের হাড়ের মাঝখানে থাকা ডিস্ক যদি সরে যায় বা চেপে যায়, তখন রাতে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। অনেক সময় শোবার ভঙ্গি বা কম চলাফেরা করার কারণে এই ব্যথা তীব্র হয় এবং মাঝরাতে ঘুম ভাঙায়।
৪. স্নায়ুর উপর চাপ (Sciatica)
সায়াটিকা নার্ভে চাপ পড়লে কোমর থেকে পায়ের দিকে টান অনুভব হয়। এই ব্যথাও অনেক সময় রাতে তীব্র হয় এবং ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
৫. সোশ্যাল এবং মানসিক চাপ
মনঃসংযোগ, উদ্বেগ বা দীর্ঘ সময় মানসিক চাপ থাকলেও পিঠে ব্যথা দেখা দিতে পারে। কারণ মানসিক চাপ সরাসরি পেশীর টান সৃষ্টি করে, যা ঘুমের সময় ব্যথা বাড়াতে পারে।
৬. রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা অ্যানকাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিস (AS)
এই দুটি অটোইমিউন রোগের কারণে মেরুদণ্ডে প্রদাহ হয়, যা সকালে ঘুম থেকে উঠার পর কিছু সময় ব্যথা এবং শক্ত ভাব তৈরি করে। রাতের দিকে এই প্রদাহের কারণে ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
সকালে ব্যথা না থাকলে কি সমস্যা কম?
অনেকে ভাবেন, সকালে যদি ব্যথা না থাকে তাহলে বিষয়টি হয়তো গুরুতর নয়। কিন্তু বারবার যদি মাঝরাতে ঘুম ভাঙে এবং পিঠে ব্যথা অনুভব করেন, তবে এটা নীরব কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করলে ভবিষ্যতে এই সমস্যা স্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
নিচের লক্ষণগুলো থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:
-
ব্যথা প্রতিদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙায়।
-
ব্যথা কোমর থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
-
পেশী দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বা পায়ের শক্তি কমে যাচ্ছে।
-
ওজন হ্রাস পাচ্ছে অকারণে।
-
ব্যথা হাঁচি বা কাশিতে বেড়ে যাচ্ছে।
-
প্রস্রাব বা মলত্যাগের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে।
বাসায় করণীয় ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
১. সঠিক ঘুমানোর ভঙ্গি নির্বাচন করুন
-
পাশে কাত হয়ে ঘুমানো সবচেয়ে ভালো, হাঁটুর নিচে বালিশ রেখে দিন।
-
পিঠের উপর ঘুমালে হাঁটুর নিচে একটা ছোট বালিশ দিন।
-
পেটের উপর ঘুমানো এড়িয়ে চলুন।
২. ম্যাট্রেস ও বালিশ পরিবর্তন করুন
-
মেরুদণ্ড সাপোর্ট করে এমন অরথোপেডিক ম্যাট্রেস ব্যবহার করুন।
-
গলা ও ঘাড় সাপোর্ট করে এমন বালিশ বেছে নিন।
৩. হালকা ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করুন
-
প্রতিদিন সকালে ও রাতে ৫-১০ মিনিট ব্যায়াম করুন।
-
"ক্যাট-কাউ স্ট্রেচ", "চাইল্ড পোজ", এবং "পেলভিক টিল্ট" ব্যথা কমাতে কার্যকর।
৪. গরম সেঁক ব্যবহার করুন
-
গরম পানির ব্যাগ বা হট প্যাড ব্যবহার করলে রক্ত চলাচল বাড়ে ও পেশীর খিঁচুনি কমে।
৫. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
-
অতিরিক্ত ওজন পিঠের উপর চাপ বাড়ায়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত চলাফেরা করে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
৬. অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন রাতে
-
এগুলো ঘুমের গুণমান কমিয়ে দেয় এবং ব্যথার অনুভূতি বাড়াতে পারে।
শেষ কথা
পিঠের ব্যথা নিয়ে অনেকেই গুরুত্ব না দিয়ে দিনের পর দিন চালিয়ে যান। কিন্তু যদি এই ব্যথা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেয় এবং প্রতিনিয়ত ঘটে, তাহলে তা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। জীবনযাত্রায় কিছু ছোট পরিবর্তন এনে, ব্যায়াম করে ও সঠিকভাবে ঘুমিয়ে আপনি এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান করতে পারেন। তবে উপসর্গ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা বাড়তে থাকে, দেরি না করে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
আপনার ঘুম হোক স্বস্তির, এবং পিঠ থাকুক ব্যথামুক্ত।